প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (৩য় পর্ব)

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুবাদ, ধারাবাহিক, প্রবন্ধ, রিভিউ
Bengali
প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (৩য় পর্ব)

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show

পরবর্তী পর্ব এখানে>>>>

পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>>

       প্রিয় পাঠক, আসুন ফ্যান্টাসির এই তৃতীয় পর্বে আপনাকে স্বাগতম। তৃতীয় তাই তিনটে বিস্ফোরণ নিয়ে হাজির আমাদের এই চলমান প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশো ─

১। অভিব্যক্তির উপায়ান্তর (Expression by other means)
২। নিমনন্দনতত্ত্ব (Anaesthestics)
৩। প্রতিকারহীনতা (Irremediation)

     এই বিস্ফোরণগুলোর (চার্লস বার্ন্সটাইনের শব্দ fit –এর বাংলায়ন) আসল, মনোজ্ঞ, চিন্তাশীল (প্রিয় পাঠক ক্ষমা করবেন এতগুলো বিশেষণ দিচ্ছি শুধুমাত্র চার্লস বার্ন্সটাইনের sincerity বোঝাতে আমার ভূমিকার উল্টোপিঠে) রন্ধন সেরে রেখেছেন চার্লস বার্ন্সটাইন। আমার এই মুখবন্ধ একটু ফোড়ন ব্যতীত কিছু নয়। আর প্রিয় বাঙালি পাঠক আপনি ছাড়া আর কেবা জানেন সাহেবসিদ্ধ মাল-এ (content অর্থে, পাড়াতুতো দাদাকৃত অর্থটি এখানে প্রযোজ্য নয়) একটু মশলা ফোড়ন দিয়ে খুশবাই সম্ভাবনা। আর আমাদের বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দের রিইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন যিনি সেই শ্রদ্ধেয় কলিম খান তো বলেই গেছেন মুখবন্ধ শব্দটি আদতে খন্‌ ক্রিয়ামূলের বংশজাত। খন্‌-> ক্ষ্‌(খাবলানো) অন (on)। অর্থাৎ খাবলানো অন থাকে যাহাতে। অর্থাৎ মূল ‘মাল’ থেকে খাবলে খুবলেই এই মুখবন্ধ, যাকে বার্ন্সটাইন তাঁর sincere ভাষায় বলছেন “commentary in and around the content”

অভিব্যক্তির উপায়ান্তর :

      উপায়ান্তর -> উপায়+অন্তর। একটা উপায় যখন ক্লিশে বা গতানুগতিক হয়ে ওঠে তখন মন চায় অন্তর। দোহাই পাঠক, অন্তর শুনেই আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ মানে করে বুকের বাঁদিকে হাত রাখবেন না প্লিজ। প্রথমত ওইখানে লাবডুব শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। অতি প্রাচীন এই তর্ক। আপনি তো ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন সুদূর সপ্তদশ শতাব্দীতেই দেকার্তের “দ্য প্যাসান অফ দ্য সোল” কিম্বা “ট্রিটিজ অফ ম্যান” তার পিনিয়াল নিউরোসাইকোলজি নিয়ে মনকে বুক থেকে তুলে মাথায় বসিয়েছে। এই হৃদয় বা মন বস্তুটা খুবই ঘোলাটে। এই কোভিড যুগে এমনিতেই ঘুলিয়ে আছি আমরা। তার মধ্যে আপনাকে আরো ঘুলিয়ে দেবার ইচ্ছে আমার নেই। এ ‘অন্তর’ হ’ল অন্য বা ভিন্ন অর্থে।

    উপায় -> উপ-আয়; আয় হ’ল যাহা (অস্তিত্বধারীর কাছে) আসে। আর উপায়=উপ-আয় (উপরি যাহা আসে – এ আমাদের এত চেনা যে কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না)। তো ওপথে না গিয়ে আয় এর কথায় আসি। অর্থাৎ আয় হ’ল যাহা আসে come-in. উল্টে  in-come উল্টো পথে চলে। মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিন গ্রহণ করে বা করতে বাধ্য হয়। তার গ্রহণের জন্য ‘যাহা আসে’ সেগুলোই আয়। এই শব্দে স্বভাবতই দৈহিক ও মানসিক সর্বপ্রকার আয়ই বোঝায়। যা কিছু অর্থকরী বস্তু জনন করা হয়, যার পেছনে আমাদের চেষ্টা কাজ করে তাই অর্জ্জন; তা সে দৈহিক বা মানসিক যে কোনো ধরণের অর্থকরী বস্তুই হোক না কেন, এবং এক অর্থে তাও অর্থ আনে তা সে টাকা-অর্থ হোক আর মানে-অর্থই হোক। তাই সেটিও একধরণের আয় এবং তা চেষ্টার্জিত। কিন্তু আয় ও অর্জ্জনকে এক করে ফেললে ‘অনুভবের জগৎ’ যাকে বলা যায় conceptual world ছোট হয়ে যায়। বস্তুত আয় হ’ল সমাজস্বীকৃত পথে যাহা আসে। তো এ হ’ল দৈহিক অর্থকরী বস্তু। আমরা একটু মানসিক হতে চাইছি। মানে বলতে চাইছি যে এই আয় হ’ল মানে বা means বা way অর্থে অর্থকরী বস্তু, যা আমাদের মন অর্জ্জন করে। আর উপ হ’ল বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে পালন করে যে। ফলত, আয় এর সঙ্গে উপ জুড়ে ‘মানে’-এর পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন রূপের কথাই নির্দেশ করছে। সুদূর খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর পাণিনিপূর্ব নিরুক্তকার যাস্ক-এর নিরুক্ত[i] বলছে, ‘উপ’ উপসর্গটি ‘উপজনন’ করে, অর্থাৎ জনন যা হবার তা তো মূল শব্দটি করছেই, বাড়তি যে জনন সেটি করে এই ‘উপ’।

      তো নির্যাসে হাতে যাহা আসে ─ উপায়ান্তর -> ভিন্ন উপায় ->other means. যেহেতু আমাদের নাইটশো কবিতা নিয়ে সুতরাং Expression বা অভিব্যক্তির কথা উঠবেই। বার্ন্সটাইন বলেন, “কবিতার সামাজিক কাজ অভিব্যক্ত করা নয় বরং অভিব্যক্তির সম্ভাবনাগুলো্র খোঁজ করা”।[ii] এই অভিব্যক্তির প্রচলিত উপায়গুলো যখন ক্লিশে হয়ে আসে, গতানুগতিকতার একঘেয়েমিতে তিক্তবিরক্ত, তখন খোঁজ পড়ে ওই অন্তরের─ হাতে আসে ফ্যান্টাসির সেই fit বা বিস্ফোরণ─ অভিব্যক্তির উপায়ান্তর, বার্ন্সটাইন যার নাম দিয়েছেন ─ Expression by other means. প্রিয় পাঠক, এইখানে আর একটি কথা বলে রাখা জরুরি। এই সমস্ত অর্থঅনর্থ আমার জ্ঞান বা উর্বর কল্পনাপ্রসূত এমত সন্দেহপোষণ করার কোনো কারণ দেখি না। কারণ আপনি ইতিমধ্যেই জানেন, তবু আর একবার বিনীতভাবে আমার স্বীকারোক্তিটুকু আপনাকে জানিয়ে রাখি যে, এ বান্দা ও সমস্ত গুণরহিত। সবই ধারে কারবার। বাংলাভাষার মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় কলিম খানের অসাধারণ গবেষণাভিত্তিক শব্দার্থকোষ হাতড়ে এই জ্ঞান আহরিত। রেফারেন্সে[iii] বিস্তারিত বিবরণ রইল।

        তো এই বিস্ফোরণের বিষয়বস্তু হ’ল একটি কবিতা পাঠ করতে গিয়ে কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন। দুই মার্কিন সমালোচক ক্রেগ দ্বোয়ার্কিন ও কেনেথ গোল্ডস্মিথ একটি অ্যান্থলজি যুগ্মসম্পাদনা করেন ─ Against Expression: An Anthology of Conceptual Writing ভূমিকায় তাঁরা বলেন যে, কোনও রচনার পাঠ নির্ধারণে থিম বা বিষয়বস্তুর পরিবর্তে রচনার কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেগ দ্বোয়ার্কিনের নিবিড় পাঠের গভীর রসায়ন হ’ল বহিরঙ্গের বোধ। আপনি ইতিমধ্যেই জানেন বা নিজের থেকেই যা দেখতে পান, তা নিয়ে দ্বোয়ার্কিন বলবেন না, বরং যাকে ঠাহর করে না দেখলে সনাক্ত করা যায় না, তাই দেখান। সম্ভাব্য অলক্ষিত অসামঞ্জস্যগুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন, যাকে বলেছেন “সাহিত্যের অপসারণ”─ সংকেত মুছে ফেলা, মাধ্যম খারিজ করা, রচনার সঙ্গে যুক্ত অন্য অংশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, যা এডগার অ্যালান পো-এর তত্ত্বকে প্রতিধ্বনিত করে : “শুধুই শূন্যতা আর কিছুই নয়”।

নিমনন্দনতত্ত্ব :

   বার্ন্সটাইন তাঁর ফ্যান্টাসির একটি বিস্ফোরণের নামকরণ করেছেন Anaesthestics ->Anaesthesia+aesthetics তো অ্যানাস্থেসিয়া প্রক্রিয়ার সঙ্গে নান্দনিকতার মেলবন্ধন। বার্ন্সটাইনের এই তত্ত্ব নন্দনতত্ত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়, বরং বাঁক নেওয়া, খোঁজ করা এক নতুন সৌন্দর্যের ─ যা বাঁধা পড়েনি নৈতিকতার নিগড়ে; যে সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা অসাড় করে রাখেনি চেতনাকে; যা গণ্ডিবদ্ধ বা বশীভূত হয়নি প্রতিষ্ঠানের চাপে। এ এমন এক নন্দনতত্ত্ব যা প্রচলিত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নাকচ করে, এমন এক অ্যানাস্থেসিয়ার প্রক্রিয়া যা যন্ত্রণামুক্ত করতে কেবল মাত্র অচেতনই করে না, ওই সৌন্দর্যচেতনার শিকড় উপড়ে রাখে যাতে এক নতুন সৌন্দর্যের স্বপ্ন দেখতে শেখে, যেখানে সৌন্দর্যের সম্ভাবনারা ডানা মেলতে পারে, যেমন বার্ন্সটাইন বলছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ The Sophist[iv] এর কবিতা “Surface Reflectance”:

শুধু মাত্র অচেতন করা
বা ব্যথামুক্ত করার থেকেও
আরো কিছু আছে অ্যানাস্থেসিয়া রূপায়ণে।
একজন অ্যানাস্থেটিস্ট
খিঁচুনি বা স্বরভঙ্গি
দমন করতে তাকে শেকড় থেকে
উপড়ে রাখতে পারেন।
কম বিষাক্ত পদ্ধতি হ’ল
সংকেতগুলোর অবরোধ
কিম্বা উৎস থেকে গন্তব্যে
যাওয়ার পথে হস্তক্ষেপ করা।

      তো এই অভিধান বহির্ভূত শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ (পড়ুন কব্জা) করতে আমাকে যেতে হ’ল সত্তরের দশকের সেই “না-সাহিত্য, অল্প-সাহিত্য, তিক্তবিরক্ত সাহিত্য” নিম সাহিত্য আন্দোলনের দরবারে, যেখানে দেখতে পেলাম বার্ন্সটাইনের এই তত্ত্বের কোহেরেন্স। তাই নিমের ঋণ নিয়ে তৈরি হ’ল এই বিস্ফোরণের নাম নিমনন্দনতত্ত্ব। এ ঋণ তো শুধু স্বীকারই করা যায়, পূরণ করতে জীবনভোর ভালোবাসা। পশ্চিমবাংলায় বাংলা ভাষার বিকল্প সাহিত্যধারায় এক উল্লম্ফন এক নতুন বাঁক এনেছিল সেই নিম সাহিত্য আন্দোলন ─ যার টুকরো পরিচয় তুলে দিচ্ছি এই আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম লেখক সেই রবীন্দ্র গুহর[v] বয়ানে, যাঁর কাছে সাহিত্য হ’ল নিত্য প্রবহমান চৈতন্যের ভাষাভিত্তিক ফটোগ্রাফি ─

পরিচালনায় ছিলেন শিল্পাঞ্চলের লালদূর্গ দুর্গাপুরের নিম লেখকবৃন্দ :

মেরুদণ্ড : সুধাংশু সেন
পাকস্থলী : রবীন্দ্র গুহ
নাভিমূল : বিমান চট্টোপাধ্যায়
ফুসফুস : মৃণাল বণিক
কণ্ঠাস্থি : নৃসিংহ রায়
নিতম্বাস্থি : অজয় নন্দীমজুমদার

আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো থেকে দুচারটে ফোড়ন :

ক) বোধের মূলে নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করুন।
খ) লেখক হওয়ার বাসনা জাগামাত্রই আত্মহত্যা করুন।
গ) সাহিত্য অভিজ্ঞতার ফল নয়, অবিকৃত অভিজ্ঞতাই সাহিত্য।

প্রতিকারহীনতা :

   বিষয়: কবি হার্ট ক্রেনের বহুআলোচিত দীর্ঘকবিতা “দ্য ব্রিজ”-এর ব্যর্থতা বা সাফল্যের স্বীকৃতি নিয়ে নীতিবাগিশ ও প্যাটাক্যুয়রিক্যাল সমালোচকদের বিতর্ক। নীতিবাদীর মতে ক্রেনের কবিতাটি সমন্বয়ী সমগ্রতায় ধরা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, বড়োজোর বলা যায় অসম্বদ্ধ লিরিক বিস্ফোরণ মাত্র। আর পি ব্ল্যাকমুরের “অত্যুজ্জ্বল ব্যর্থতা”-র ভাবনাকে আরো প্রসারিত ক’রে এবং স্যামুয়েল আর ডিলানির ব্যর্থতার ভিন্ন ফ্রেমের ধারণাকে প্রসারিত ক’রে বার্ন্সটাইন একে “অনুজ্জ্বল সাফল্য” বলছেন─ কারণ “দ্য ব্রিজ”-এর নান্দনিক শক্তি শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক সংবেদনার বিস্ফোরণ সত্ত্বেও নয় বরং তারই সংযোগে ঘটে, সেতুর ওপর ক্ষণস্থায়ী যৌনতা বিনিময়ের অনুরূপ। যা প্রতিধ্বনিত করে এডগার অ্যালান পো-এর ফ্ল্যাশপয়েন্ট নন্দনতত্ব ─ সমস্ত দীর্ঘকবিতাই বহু সংক্ষিপ্ত এবং অনির্দিষ্ট ঝলক-এর সমাহার। বার্ন্সটাইনের এই প্যাটাক্যুয়রিক্যাল প্রতিকারহীনতা চিহ্নিত করে ক্রেনের প্রতিকারহীন ব্যর্থতা, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় পো-এর “কখনও বেশি নয়” তত্ত্বে, যেখানে মুখ দ্যাখে বার্ন্সটাইনের কবিতার নেতিবাচক অর্থনীতি─ ক্ষতি তীব্রতাকে দীর্ঘায়িত করে।

     প্রিয় পাঠক, আপনি তো জানেন, ফোড়ন বেশি দিলে স্বাদ নষ্ট হয়, ওই খানিকটা পো-এর মতো “never more”    আসুন তাহলে আসলে ফিরি।

Cock-a-doodle-de-dooooooh!

@@@   চার্লস বার্ন্সটাইনের ফ্যান্টাসির তৃতীয় পর্ব  @@@

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল কল্পনা : মিডরাশিক নীতিশাস্ত্রবিরোধিতা এবং আনমিতলজির[vi] প্রতিশ্রুতি
The Pataquerical Imagination:
Midrashic Antinomianism[vii] and the Promise of Bent Studies
১৪০টি বিস্ফোরণের এক ফ্যান্টাসি

XXVI. অভিব্যক্তির উপায়ান্তর (Expression by other means)

      ক্রেগ দ্বোয়ার্কিন Against Expression: An Anthology of Conceptual Writing নামে যে বইটি কেনেথ গোল্ডস্মিথের সঙ্গে সম্পাদনা করেন, তার ভূমিকায় যে কোনও রচনার পাঠ নির্ধারণে রচনার কাঠামোর গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কাঠামোর ওপর দ্বোয়ার্কিনের এই প্রাধান্য দেওয়া মনে পড়ায় আরভিং গফম্যানের “frame analysis”[viii] -এর আদর্শ রীতিকে।

     গফম্যানের স্বজ্ঞালব্ধ-বিরোধী ধারণাটি হ’ল একটা “ঘটনা” (শিল্প “বস্তু” সমেত) নিজের জন্য কথা বলে না, কেবল তার ফ্রেম বা প্রসঙ্গ দিয়েই তাকে চেনা যায়। এই কারণে, একটা ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা, সেই “ঘটনা”-র ব্যাপ্তিকাল অতিক্রম করতে পারে। একটা ঘটনা বা শিল্পকর্ম স্বপ্নের মতো অসংখ্য অসমানুপাতিক বা অসমতল ফ্রেমগুলোকে প্রকাশ করতে পারে। কিছু ফ্রেম এমন আঠাল যে দাগ হয়ে আটকে থাকে।

     ফ্রেমগুলো সূত্র বা চাবির কাজ করে, আর গফম্যানের কাছে ফ্রেমের বাইরে যা আছে তা (শেষপর্যন্ত) প্রায়শই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে : এটা যা নয়, তাই দিয়ে যার সংজ্ঞায়ণ। গফম্যানের ফ্রেম ভাবাদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত (লুই অ্যালথুজারের অর্থে) আর “আমরা যা নিয়ে বাস করি তাকে রূপকায়িত করতে” ও শ্রে্ণীবদ্ধ করতে (জর্জ ল্যাকফের অর্থে): ফ্রেমগুলো সেই আতস সেই ভাষা যা দিয়ে আমরা উপলব্ধি করি, কদর করি। ভেবে দেখুন, কীভাবে উইটগেনস্টাইন তাঁর Philosophical Investigations-এ “seeing as”-র মৌলিক প্রকৃতি উপস্থাপিত করেছিলেন।

     Frame Analysis-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল জোচ্চুরির প্রতি গফম্যানের আসক্তি, যা তিনি ফ্রেমের অলক্ষিত পরিবর্তন হিসাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন : ক্র্যাপগেমের খেলায় চিহ্নটা তার নগ্ন চোখ খুলে রাখে ঘুঁটিচালনার ওপর, কিন্তু ফ্রেমের বাইরেটা হ’ল জোচ্চোরের ইশারারত চোখের সংকেত।

     সমস্ত কবিতাই (আমার বিনীত মত) জোচ্চুরি, তবে কিছু জোচ্চুরি অন্যদের চেয়ে বেশি উস্কানি দেয়। আর কিছু জোচ্চুরি আমাদের আরও ভালোভাবে পাশকাটানোর কৌশল শিখতে সাহায্য করে। এই ধোঁকা দেওয়ার খেলায় গোল্ডস্মিথের চরম উৎকর্ষ আর Against Expression-এর ভূমিকায় লেগে আছে তারই ছোঁয়া, যেখানে তিনি শ্রীমতি অপরাহর বলা স্মৃতিচারণের জোচ্চুরিগুলোকে[ix] নিয়ে মজা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই ধরনের সাহিত্যিক জালিয়াতি শিল্পজগতে এখনও বাসা বাঁধেনি, যা বর্তমানে বিষয়গত “মৌলিকত্বে” বাজারি স্বাতন্ত্র্যসূচকের চেয়ে কম বিনিয়োগ করে। যার একমাত্র অর্থ হ’ল শিল্পজগতে আপনাকে অন্য ধরণের জালিয়াতির সন্ধান করতে হবে, যা নান্দনিক যোগ্যতা আবিষ্কারের বিপরীতে বাজারি মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়া ওঠা এক চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠান।

     দ্বোয়ার্কিন ও গোল্ডস্মিথ ভালো সহযোগী কর্মী, কারণ যদিও তাঁরা এই অ্যান্থোলজিতে সংগৃহীত রচনার কাজের জন্য অবশ্যই উৎসাহ ভাগ করে নিয়েছেন, তবু তাঁদের কাব্যতত্ত্বের অভিমুখ সবসময়ই খুব ভিন্ন ছিল। দ্বোয়ার্কিনের সামাজিক ফর্মালিস্ট ভাষ্য ও সারাংশ একাধারে উত্তেজক ও সম্মোহক। তিনি ফর্ম, কাঠামো ও গ্রন্থপঞ্জি সংক্রান্ত সংকেতগুলোর (থিম বা বিষয়বস্তুর পরিবর্তে) বিশদ বিবরণ দিয়েছেন সম্ভাব্য অলক্ষিত অসামঞ্জস্যগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগসহ; কট্টর ও রহস্যময় শিল্পচর্চার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে “সাহিত্যের অপসারণ” ─ সংকেত মুছে ফেলা, মাধ্যম খারিজ করা, রচনার সঙ্গে যুক্ত অন্য অংশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া ─ সর্বতোভাবে শূন্যতার নগ্ন কাব্যতত্ত্বের বাঁধ ভেঙে দেয় : মর্মরিত নৈঃশব্দ্য। (“শুধুই শূন্যতা আর কিছুই নয়”: “শুধু এইটুকু, আর কিছু নয়”)।

     দ্বোয়ার্কিন এক প্রতিভাবান পাঠক; তিনি সেই চূড়ান্ত পাঠ্যচর্চা ও রচনাগুলোর সঙ্গে গভীর একাত্মবোধ করেন, যা লেখার স্পষ্টতা, বোধগম্যতা ও সংবেদনশীলতার সীমার ওপর জোর দেয়। দ্বোয়ার্কিনের অভিমুখের গভীর বিষয়টি হ’ল বহিরঙ্গের বোধ : তিনি সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে অস্বীকার করেন, প্রচলিত পাঠ বা কবিতাটির উপলব্ধি স্থগিত রাখেন, যাতে তিনি পাঠ্য অসঙ্গতি ও স্বজ্ঞালব্ধ-বিরোধী শব্দার্থের প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। আপনি ইতিমধ্যেই জানেন বা নিজের থেকেই যা দেখতে পান, তা নিয়ে দ্বোয়ার্কিন বলবেন না, বরং যাকে ঠাহর করে না দেখলে সনাক্ত করা যায় না, তাই দেখান। তাঁর নিবিড় পাঠের মধ্যে একজন খেলোয়াড়ের সংগ্রামী মনোভাব থাকে; যেখানে অনুভব করা যায় যে, অর্থের জন্য তাঁর খোঁজ একক মনোযোগ ও অস্বাভাবিক ধৈর্য দাবি করে।

     দ্বোয়ার্কিনের প্রবন্ধগুলো প্রায়শই রচনার গতি ও চিহ্নের মধ্যে অর্থ খুঁজে পাবার, প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পাবার বিষয়ে আগ্রহী, যা আমরা বেশিরভাগই উপেক্ষা করি, প্রকৃতপক্ষে লেখকও এ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন (বা মোটেই অবগত নন)। দ্বোয়ার্কিন অর্থ ও অভিব্যক্তি খুঁড়ে বার করেন, গফম্যান যাকে বলেন উপেক্ষিত পথ : সেই জায়গা যেখানে আপনি দেখছেন না। ফলত দ্বোয়ার্কিন নির্মিত পাঠ্যের ভাঁজের ভেতর উদ্বৃত্ত অর্থ খুঁজে পান; কে বা কী এটা “প্রকাশ” করছে সেটাই একটা আলোচ্য বিষয়– এই ভাবটাকে সীমাবদ্ধতা বলে মনে করে তিনি প্রায়শই তা অস্বীকার করেন।

    অপরদিকে গোল্ডস্মিথ কখনও কখনও বলতেন যে আপনাকে তাঁর রচনাটি পড়ার দরকার নেই, বরং আপনাকে যা করতে হবে তা হ’ল ধারণাটি পাওয়া। দ্বোয়ার্কিনকে মাথায় রেখে বলা যায়, যে এর মানে হচ্ছে রচনাটি পুনরায় পড়া দরকার, প্যাটাক্যুয়রিক্যাল মনভাবে, সরলিকৃত পন্থার বিরুদ্ধে (অভ্যাসগত অভ্যাসের বিরুদ্ধে) আর খোঁজ করতে হবে প্রস্তাবিত পথ থেকে কোনপথে সে বিপথে যায়। “স্বীকৃত ইতিহাস ও সাধারণ অন্তর্ভুক্তি অতিক্রম করে দেখলে যে কেউ সহজেই দেখতে পাবে সেই পাঠ্য উপাদানগুলো, যা অস্পষ্ট বা অন্তর্নিহিত ছিল”। দ্বোয়ার্কিন অ্যান্থলজির ভূমিকাতে লিখছেন, “পুনর্গঠনের এই সহজ কাজটি মনে হয় একজনের দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুন প্রাণ দেয়, যাতে পরিচিত কাজটিও তাদের নতুন প্রসঙ্গের ভিত্তিতে লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন বলে মনে হয়”।

     দ্বোয়ার্কিন তাঁদেরকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, যাঁরা Against Expression শিরোনামটিকে নেহাতই বালখিল্যতা মনে করতে পারেন এই ভেবে যে, অন্যান্য কবিতার অ্যান্থলজির মতো এই অ্যান্থলজির রচনাগুলো ততটা অভিব্যক্তিপূর্ণ নয়। গত চল্লিশ বছর ধরে এটাই তর্কের বিষয় যে, একটি নির্দিষ্ট সূত্রমাফিক ভাষাগতভাবে আমি-কেন্দ্রিক, ধারণাগতভাবে সার্বভৌম-স্ব-কেন্দ্রিক লিরিক হল প্রভাবিত করা ও অভিব্যক্তির একটা প্রতিবন্ধক। প্যাটাক্যুয়রিক্যাল কবিতা ছন্দবিরুদ্ধ, ভাষ্যবিরুদ্ধ, মানুষবিরুদ্ধ, ব্যক্তিগতবিরুদ্ধ, অর্থবিরুদ্ধ, স্ববিরুদ্ধ নয়; এ কেবল ধারণাগতভাবে শূন্য সেই রীতি কিনতে যায় না, যা প্রাতিষ্ঠানিক কবিতাধারার অনুমোদিত অভিব্যক্তি, স্বরসংযোগ আর আমাদের “এ সেই জটিল” ব্যক্তিত্ব।

     অভিব্যক্তির নেক্রোহিউম্যানিস্ট অর্থে “অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে” হওয়া মানে আনমিতলজির বিস্তৃত ক্ষেত্রে অভিব্যক্তির স্বপক্ষে হওয়া।

অভিব্যক্তির উপায়ান্তর

     এটাই স্পষ্ট হয় যখন দ্বোয়ার্কিন লেখেন, “আমাদের ঝোঁক সেইরকম কাজের প্রতি, যা অনন্য, সুসংগত বা সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বতন্ত্র মনোবিজ্ঞান প্রকাশ করতে চায়, তার খোঁজ করে না, পরন্তু কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের পরিচিত কৌশলগুলো অস্বীকার করে”। এক মনোরম বিতর্কিত ধাক্কা দেওয়া গেছিল যখন দ্বোয়ার্কিন জোর দিয়ে বললেন যে, “অব্যাহত” এবং “ন্যূনতম হস্তক্ষেপ”-এর পদ্ধতিগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে : “প্রায়শই আমাদের স্বীকার করতে হয়েছিল যে, আমরা যে কাজগুলিকে প্রশংসা করেছিলাম তারা এই সংকলনের পক্ষে একেবারেই সঠিক ছিল না – কারণ তারা কেবল বড্ড বেশি সৃজনশীল ছিল – সেখানে ছিল অনেক বেশি কর্তৃপক্ষীয় হস্তক্ষেপ, যতই না কেন সেই হস্তক্ষেপ দক্ষ বা কেতাদুরস্ত হোক”। একগাদা দক্ষ হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল এই অ্যান্থলজি তৈরির জন্য। আর যদি ব্যক্তিগত শব্দের চেয়ে জটিল গঠন পছন্দের উদ্দেশ্য থাকে, তবু তাও কেতাদুরস্ত হস্তক্ষেপ। আমি মনে করি জ্যাকসন ম্যাক লোও কষ্ট পেয়েছিলেন যখন তাঁর রচনাকে হয়ে ওঠার বদলে ‘দৈবক্রমে’ রচিত বলে বর্ণনা করা হয়েছিল, তাঁর ভাষায় যা আধা-উদ্দেশ্যমূলক। এখানেই সমালোচক হিসাবে দ্বোয়ার্কিনের প্রকৃত পরিচয় পাই: আধা-উদ্দেশ্যমূলক ভাষাগত ঘটনার নিবিড়তম পাঠ ও শ্রেণিবিন্যাস। এটা পাঠ বা হস্তক্ষেপের ছল নয় বরং ঝুঁকি বাড়ানো ও কখনোসখনো গঠনক্ষমতার প্রতি উৎসাহী প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

   দ্বোয়ার্কিন লেখেন, যে তিনি যে কবিতাগুলো এই অ্যান্থলজিতে রেখেছেন “তারা অ-ব্যক্তিগতও নয়, আবেগহীনও নয় বরং প্রচলিত অভিব্যক্তিবাদী অলঙ্করণের ভাবপ্রবণতা, অভ্যাস, ও ক্লিশে এড়ানো আবেগপ্রবণতা খোঁজ করা বা আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার এক আনুষ্ঠানিক উদ্ভাবনী প্রয়াস”

XXXIII. নিমনন্দনতত্ত্ব[x] (Anaesthestics)

      সৌন্দর্য বা আবেগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ব্যক্তিপরিচয় বা অভিব্যক্তি থেকে বাঁক নেওয়ার মতো, হয়তোবা উভয়েই, যা সুন্দর ও আবেগময় বলে গৃহীত তার অগভীরতার প্রতিক্রিয়া হতে পারে, হতে পারে যে সৌন্দর্য ও প্রভাব এখনও গণ্ডিবদ্ধ বা বশীভূত হয়নি তার খোঁজ। কারণ আপনি যদি বলেন আমি কোনটা সুন্দর বলে মনে করি, তা নিরর্থক, তবে আমি বলতে পারি যে আমি সৌন্দর্যকে নাকচ করি; কিন্তু সেটা হল কীভাবে সুন্দরের শ্রেণীগুলো আপনাকে সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা থেকে অসাড় করে রাখে, সেই স্বীকৃতির একটা পরিমাপ মাত্র। কারো কারো কাছে এটা কেবলমাত্র সুন্দরকে ত্যাগ করা, যাতে সৌন্দর্যের সম্ভাবনারা উন্মুক্ত হয়। আপনারা যাঁরা সৌন্দর্য বা আবেগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নিয়ে বিলাপ করেন, বাধ্যতামূলকভাবে তার ফিরে আসার ঘোষণা করেন, সম্ভবত বোঝেন না বা বুঝতে পা্রেন না, যে লিপিটির বাইরে কী থাকবে, যেমন আপনার মৃত সংবেদনশীলতা, বিস্মৃত সৌন্দর্য, যার স্বপ্ন দেখা যায় না আপনার নৈতিকতার ভেতর।

    এবং আমি সেটাই আপনাকে সবচেয়ে ব্যক্তিগত সম্ভাব্য উপায়ে বলতে চাইছি।

XL. দাবিদারহীনের বিবৃতি[xi] (Disclaimer)

      এই প্রবন্ধের মতামতগুলো পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ, ডোনাল্ড টি রেগান, রোনাল্ড রেগান, বার্নিস জনসন রেগন, বা লেখকের অভিমতের প্রতিনিধিত্ব করে না, বা তাঁদের ওপর আরোপিত করা উচিত নয়। প্রকাশিত মতামতগুলো কেবলমাত্র এই প্রবন্ধের।

XLI. প্রতিকারহীনতা [প্রতিলিপি] (Irremediation [facsimile])

    স্যামুয়েল আর ডিলানি একটি মনোগ্রাহী বিষয় উত্থাপন করেছেন যে, হার্ট ক্রেনের সমালোচনা ও জীবনীমূলক সাহিত্যে তাঁর কবিতায় সমকামিতার মাত্রাগুলোর সঠিক মূল্যায়ণ হয়নি। ক্রেনের সম্পর্কে ডিলানির দুটি প্রবন্ধ ক্রেনের অবমূল্যায়নকারীদের বোঝার জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফ্রেম তৈরি করেছে। ডিলানির এই হস্তক্ষেপকে প্রসারিত করে আমি বলতে পারি, যেমন আর পি ব্ল্যাকমুর বলেছেন তাঁর প্রবন্ধে “Notes on a Text of Hart Crane”─ ক্রেনের এই “অত্যুজ্জ্বল ব্যর্থতা” প্যাটাক্যুয়রিক্যাল হিসেবে তাঁর “অনুজ্জ্বল সাফল্য”[xii]কে আরো বেশি প্ররোচনামূলকভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

    সম্ভবত ক্রেনের ব্যর্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণটি সর্বপ্রথম ইভর উইন্টার্সের যে অসাধারণ প্রবন্ধে পাওয়া যায় তা হ’ল “The Significance of The Bridge by Hart Crane, or What Are We to Think of Professor X”(১৯৪৩)। সেখানে উইন্টার্স ক্রেনের উদ্যোগকে রালফ ওয়াল্ডো এমারসনের সর্বনাশা ও বাতিকগ্রস্ত[xiii] আইডিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন ভায়া হুইটম্যানের অধার্মিক সর্বেশ্বরবাদ (পড়ুন আপেক্ষিকতাবাদ…) আর মালার্মের দ্বিভাববাতিকের[xiv]  সঙ্গে… এটা উপলব্ধি করা জরুরি যে ক্রেনের এই প্রত্যাখ্যান বা নিদেনপক্ষে নিন্দাবাদ উইন্টার্স ও ক্রেনের বহু সমালোচকদের জন্য মার্কিন সাহিত্য প্রযোজনার পুরো রোমান্টিক প্রবাহের প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা, একটা প্রবাহ যা ক্রেনের সঙ্গে হুইটম্যান ও এমারসনকে যুক্ত করে শুধু তার সর্বশেষতম চিড়খাওয়া ও বিপথচালিত বাচনে (“Atlantis Rose,” ১৯২)।

    তাঁর নীতিবাদী সমালোচকদের জন্য ক্রেনের কবিতা সমন্বয়ী সমগ্রতায় ধরা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, বড়জোর অতিমাত্রায় উত্তেজনার হাইলাইটের এক সিরিজ হয়ে উঠেছে এবং অসম্বদ্ধ লিরিক বিস্ফোরণ যা নিজেকে বহন করতে পারে না। “শুধু এই, আর কিছু নয়।” এ সেই অভাব যা “The Poetic Principle” –এ পো-এর ভাষায়, দীর্ঘ কবিতা শুধুমাত্র এক সম্ভাব্য সিদ্ধিকে চিহ্নিত করে : যোগান দেয় প্রতিদানহীন মুহূর্তগুলোর “শিহরিত পুলক” :

    একটা কবিতার কাছে আমার চাহিদা বড়জোর আত্মার উন্নতিকল্পে সে কতটা উসকে দিতে পারে। কবিতার মান নির্ভর করে এই ওসকানোর উন্নয়ণ মাত্রার অনুপাতে। তবে সমস্ত উত্তেজনা হ’ল মানসিক (আধ্যাত্মিক) প্রয়োজনীয়তার মধ্যে দিয়ে, ক্ষণস্থায়ী। সেই উত্তেজনার মাত্রা, যা একটা কবিতাকে অধিকার দেবে, যদি আদৌ সেভাবে বলা যায়, তবে তা কখনই বড় দৈর্ঘ্যের রচনার পুরোটা সময় জুড়ে ধরে রাখা যায় না। বড়জোর আধঘন্টা সময় অতিবাহিত হলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে— ব্যর্থ হয় — অনুভবের এক আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে— আর তারপরে কবিতাটি আসলে কার্যত আর সেরকম থাকে না।

    আমি পোয়ের আক্রমণাত্মক নন্দনতত্ত্বের (“সংক্ষিপ্ত এবং অনির্দিষ্ট ঝলক”) প্রয়োগ করতে চাই সেই বিষয়ে, যার ওপর ডিলানির জেদ যে ক্রেনের ‘ব্রুকলিন ব্রিজ’ ছিল একটি সমকামীর চষে বেড়ানোর সক্রিয় স্থান; তীব্র, পাঁচমিশালি, ক্ষণস্থায়ী, সৃজনশীলক্ষমতারহিত যৌনতা বিনিময়ের স্থান। ক্রেনের কবিতার তৃতীয় অধ্যায়ে ডিলানি বলেন “পিক-আপের ব্যর্থতার কারণে দ্য ব্রিজ-এ CuttySark হ’ল অব্যক্ত সমকামী আকাঙ্ক্ষার, যোগাযোগের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত কেন্দ্র”। দ্য ব্রিজ -এর নান্দনিক শক্তি শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক সংবেদনার বিস্ফোরণ সত্ত্বেও নয় বরং তারই সংযোগে ঘটে, (নীতিবাদীরা একে বিকৃত বলতে পারেন); সেতুর ওপর ক্ষণস্থায়ী যৌনতা বিনিময়ের অনুরূপ। আমার বক্তব্য হ’ল নান্দনিক প্রক্রিয়াকে যৌনতার রূপক হিসাবে ব্যবহার করা নয়, বরং উল্টোভাবে; আসলে ডিলানি অনেক অন্যরকম একটা ফ্রেম দিয়েছেন ‘ব্যর্থতা’-র জন্য (অ্যানিম্যালাডি), শূন্যতার এক ড্রয়িং হিসেবে, অন্যভাবে বলা যায়, “ব্যর্থ পিক-আপ,” নান্দনিক আগুনকে ওসকানো (“শুধু এই আর কিছু নয়”)। তার ওপর এই উত্থিত, তীব্র, উত্তেজনার নান্দনিকতা, পো এর ভাষায়, আসুন একে অবিলম্বন বলা যাক, ক্রেনের বারবার ফোনোগ্রাফ শোনার অভ্যাস রাভেলের বোলেরোর ক্লাইম্যাক্সের সঙ্গে এমন সম্পর্কিত যেন সুরের অর্গল মুছে দিতে পারে আত্মচেতনা।[xv]

     তবে আমি যেটার সন্ধানে, তার জন্য আরো ভালো শব্দটা হ’ল প্রতিকারহীনতা, যা চিহ্নিত করে প্রতিকারহীন ব্যর্থতা, যা প্রতিধ্বনিত পো-এর তত্ত্বে; “কখনও বেশি নয়”। “ক্ষতির দিকে নজর: আমি একবার তাল রেখে চলেছিলাম, তবে এখন আমি বাঁধা হারে”।[xvi] কবিতার নেতিবাচক অর্থনীতিতে, ক্ষতি তীব্রতাকে দীর্ঘায়িত করে।

     ক্রেন ও পো একই সুরক্ষতাহীন জীবননৌকোয়। পো ও ক্রেনের বিরুদ্ধে বিতর্কটা দৃষ্টান্তমূলক বলের সঙ্গে অনুসৃত হয় ইভর উইন্টার্সের গ্রন্ধ Primitivism and Decadence: A Study of American Experimental Poetry (১৯৩৭) আর In Defense of Reason (১৯৪৭) দিয়ে এবং প্রসারিত হয় উইলিয়াম লোগানের ২০০৭ সালের ক্রেনের ছাইভস্ম পর্যন্ত, হ্যাঁ, সেই “ব্যর্থতা”, লাইব্রেরি অফ আমেরিকার ক্রেনের গর্বিত সংস্করণ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইম্‌সের সমালোচনা:

    “দ্য ব্রিজ”-এর বেশিরভাগ এখন জড় মনে হয় — সুদীর্ঘ, উদ্ধত, অতিঅলংকৃত, মার্কিনী মিথে রেশমিত, ডিজনি সম্পাদিত…তাঁর জাঁকজমকে খুব সহজেই চমৎকারিত্বের জন্য বিভ্রান্তি হতে পারে…কোনো এক স্বপ্নদর্শীর প্রকৃত আবেগময় সুরে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ভাবপ্রবণতায়… “দ্য ব্রিজ” রয়ে গেছে এক দুর্দান্ত স্থাপত্যের নীলনকশা হিসাবে, যা কোনো সংযমী ক্রেন দিতে পারতেন না।[xvii]

    টাইমস-এ ঠাণ্ডা লড়াই ভাবাদর্শের বলবৎকারী লোগান তাঁর প্রদর্শনমূলক তত্ত্বাবধায়ন দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন শিরোনামে আটকে পড়া এক ভাবারোহের ব্যক্তিত্ব, যা সম্ভবত তাঁর নিজের তৈরি করা নয়- “হার্ট ক্রেনের ব্রিজ কোথাও নেই” – স্বীকার করতে অপারগ যে এই ‘কোথাও নেই’-টাই ক্রেনের সেই স্থান, যেখানে তাঁর পাঠকরা থাকতে চান।

    ক্রেন এই ব্যাপারটা জানতেন। ১৯২৬ সালে তিনি হ্যারিয়েত মনরোকে চিঠিতে লিখছেন:

   কোনো কবিতায় অনুভূতি এবং পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্ম তারতম্যগুলো কিছু স্বাধীনতার জন্য ডাক দিতে পারে, যাতে কবির কোনও অধিকার নেই বলে তুমি দাবি করো। আমি কেবল এটুকুই দাবি করছি যে, কবির সেই কর্তৃত্ব আছে আর এটাও অস্বীকার করি যে, এটা হ’ল অতীতের কিছু সমৃদ্ধ প্রতিভাধরদের নির্বাসিত করার জন্য মাধ্যমের পরিধিটাকে যথেষ্ট পরিমাণে সীমাবদ্ধ করা।[xviii]

   “Cock-a-doodle-de-dooooooh!”

XLVI.

অকৃত্রিমতার বিপরীতে, কৃত্রিমতা নিদেনপক্ষে সত্যের দিকে আঙুল তোলে। আর সেইখানেই পাপ।

————

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show


[i] নিরুক্ত – যাস্ক প্রণীত বৈদিক অভিধান, যেখানে বৈদিক (সংস্কৃত) শব্দের বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, অর্থ ও তার প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। এ হ’ল বিশ্বের আদিতম শব্দকোষ যার বিশেষত্ব হ’ল এই গ্রন্থ সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে যে─ শব্দের অর্থ শব্দের বাইরে নয়, শব্দের ভেতরেই থাকে। (নিরুক্ত, ১ম খণ্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৩)।

[ii] Bernstein, Charles. 2016. Recalculating. Chicago: University of Chicago Press.

[iii] কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান, ভাষাবিন্যাস, ২০০৯

[iv] Bernstein, Charles. 1987. The Sophist. Los Angeles: Sun & Moon Press.

[v] রবীন্দ্র গুহ, কেন লিখি কিভাবে লিখি, ২০১২, কবিতা ক্যাম্পা্স, কলকাতা।

[vi] আনমিতলজি – আনমিত+লজি – Bent Studies

[vii] Antinomianism- Etymology < Greek ἀντί against + νόμος law, an ism to believe that they are not bound by moral law, instead they require to break a moral (or religious or Biblical)law.

[viii] Craig Dworkin and Kenneth Goldsmith, eds. Against Expression: An Anthology of Conceptual Poetry (Evanston: Northwest University Place, 2011). Erving Goffman, Frame Analysis: An Essay on the Organization of Experience (Boston: Northeastern University Press, 1986).

[ix] “Why Conceptual Writing?” See my discussion of frauds in “Fraud’s Phantoms,” in Attack of the Difficult Poems.

[x] নিমনন্দনতত্ত্ব ─ নিম শব্দটি ধার করা হয়েছে নিম সাহিত্য আন্দোলন থেকে। বিশদ আলোচনা ভূমিকায় রাখা হয়েছে।

[xi] দাবিদারহীনের বিবৃতি শব্দটি Disclaimer –এর বাংলায়ন হিসেবে আমার দাবি এখনও বাংলা বাঁচাও কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষ।

[xii] Samuel R. Delany, “Atlantis Rose: Some Notes on Hart Crane,” in Longer Views: Extended Essays (Middletown, CT: Wesleyan University Press, 1996). Delany discusses Blackmur’s essay on pp. 192–91. He acknowledges his debt to Lee Edelman’s Transmemberment of Song:Hart Crane’s Anatomies of Rhetoric and Desire (1987) on pp. 919–91. A related Delany work on which I have relied in this section is unpublished: Delany’s extended review and critique of Paul Mariani’s The Broken Tower: The Life of Hart Crane. “A Centennial Life from the Roaring Twenties” was first presented at the Kelly Writers House at the University of Pennsylvania on January 25, 2007; audio available at PennSound, writing.upenn.edu/pennsound/x/Crane.php. Delany provided me a copy of the manuscript.

[xiii] বাতিকগ্রস্ত -Maniagenic শব্দের বাংলায়ন, (অবশ্যই অনুমোদন সাপেক্ষ)।

[xiv] দ্বিভাববাতিক – Glossolomania শব্দের বাংলায়ন─ শব্দার্থের ভিন্ন উপয়ান্তর যাতে বাতিকগ্রস্ত ছিলেন মালার্মে। (অনুমোদন সাপেক্ষ)

[xv] Brian Reed, “Hart Crane’s Victrola,” Modernism/Modernity 7, no.1(2000). Researching any prior use of the term immediation, I discovered an article by Christoph Brunner, “Immediation as Process and Practice of Signaletic Mattering,” in Journal of Aesthetics and Culture 4(2012), www.aestheticsandculture.net /index.php/jac/article/view/18154/22833.

[xvi] “Explicit Version Number Required,” in My Way: Speeches and Poems, 191.

[xvii] William Logan, “Hart Crane’s Bridge to Nowhere,” New York Times Book Review, January 28, 2007, 18.

[xviii] english.illinois.edu/maps/poets/a_f/crane/metaphor.htm. The letter also appears in the Library of America edition of Crane.

অনুসৃজন প্রকল্প :

এটি একটি ধারাবাহিক অনুসৃজন প্রকল্প। চার্লস বার্ন্সটাইনের “The Pataquerical Imagination: Midrashic Antinomianism and Promise of Bent Studies” প্রবন্ধটির অনুসৃজন। এই তৃতীয় পর্বে পাঁচটি পরিচ্ছেদ অনুসৃজন করা হল। ইংরেজি সংস্করণ অংশুমালীর ইংরেজি সেকশানে। এই প্রবন্ধটি ২০১৬ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বার্ন্সটাইনের কাব্যতত্ত্বের বই Pitch of Poetry গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন

১ম পর্ব পড়ুন এখানে >>>

২য় পর্ব পড়ুন এখানে >>>

পরবর্তী পর্ব এখানে>>>>

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের…..